প্রতিদিন ২৪ ডেস্ক
ভারতে
অর্থের বিনিময়ে কিডনি দেওয়া বে-আইনি৻ কিন্তু গ্রামের মানুষের দারিদ্রের সুযোগে একটা চক্র সামান্য টাকা
দিয়ে কিডনি কিনে নিচ্ছে৻
অভিযোগ, এই
চক্রে জড়িত থাকেন দালাল, হাসপাতাল, ডাক্তার
– আরও
অনেকেই৻
পশ্চিমবঙ্গের
উত্তর দিনাজপুর জেলা ভারতব্যাপী কিডনি পাচার চক্রের একটা অন্যতম কেন্দ্র৻ ওই রাজ্যের বে আইনি
কিডনি প্রতিস্থাপনের মূল কেন্দ্রও উত্তর দিনাজপুরের বিন্দোল এলাকা৻
বিন্দোল
সুগন্ধি তুলাইপাঞ্জি চাল আর ভুট্টা চাষের জন্য পরিচিত৻
বিন্দোলের
বহু মানুষের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় কিছু দালাল এই কাজ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ৻ খুব সামান্য অর্থের
বিনিময়ে অঙ্গ খোয়াচ্ছেন পুরুষ-মহিলারা৻
ওষুধ
দিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল৻ আমি কিছু বুঝতে পারি নি৻ কিডনি কেটে নেওয়া হয়৻
যতীন
জালি, গ্রামবাসী
এদেরই
একজন যতীন জালি৻
দালালের পাল্লায় পড়ে কিডনি খুইয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে৻
তিনি
বলছিলেন, “আমাকে
কাজের জন্য বাইরে নিয়ে গিয়েছিল৻ সেখানে আমাকে বোঝাত যে কিডনি দিলে কোনও ক্ষতি হবে না, উল্টো
ভাল টাকা পাওয়া যাবে৻
একদিন হঠাৎই আমার রক্তপরীক্ষা করানো হয়৻ বলা হয়েছিল অপারেশন হবে৻ ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে
দেওয়া হয়েছিল৻ আমি কিছু বুঝতে পারি নি৻ কিডনি কেটে নেওয়া হয়৻”
তার
মত বড়বার, বাজবিন্দোল, মুকুন্দপুর, ভোডরা
– এই সব
গ্রামের অনেক মানুষ গত কয়েক বছরে নিজের কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ অভাব দূর
করতে স্বেচ্ছায় কিডনি বেচেছেন, কেউ আবার দালালদের দেখানো প্রলোভনে
পা দিয়ে অঙ্গ খুইয়েছেন৻ যে কয়টা টাকা পেয়েছিলেন, তাও কিছুদিনের মধ্যেই শেষ
করে আবারও অনিশ্চয়তার জীবন ৻
না
জানিয়ে কিডনি নেওয়া
না
জানিয়ে কিডনি কেটে নেওয়ার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনই রয়েছে কিডনি বেচে
প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে৻
দালালরা
বেশীরভাগ মানুষকেই প্রতিশ্রুতি মতো অর্থ দেন না। অনেকে অভিযোগ করেছেন কোন টাকাই
তারা পান নি৻
বিন্দোলের
বাসিন্দা বৃদ্ধা ফেলানি বর্মন বলেন, "আমার ছেলে ক্ষীতান এখনও
সাবালক হয় নি৻
কাজের খোঁজে গিয়েছিল বাইরে৻ সেখানেই অজ্ঞান করে কেটে নেওয়া হয় তার কিডনি – কোনও
টাকা পাওয়া যায় নি৻
কিছুদিন পরে টাকার তাগাদা দিতে দালালের কাছে গিয়েছিল৻ তারপর থেকে ছেলের কোনও খোঁজ
নেই৻”
অতি সম্প্রতি মহিলাদের কিডনি নেওয়াও শুরু করেছে পাচার চক্র৻
কথা
বলেছিলাম কয়েকজন মহিলার সঙ্গে, যারা কিডনি বিক্রি করেছেন৻ তাদের একজন বলেন, বাচ্চাদের
পড়ার খরচ জোগানো আর বাড়ি সারানোর জন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কিডনি বিক্রি করেছেন।
কিডনি
বাণিজ্য নিয়ে সমীক্ষা
কিডনি
পাচারের বিরুদ্ধে প্রচার চালান, এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার
প্রধান জবা ভট্টাচার্য কিডনি বিক্রি করা মানুষদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলেন৻
মিস
ভট্টাচার্য বলছিলেন কেন কিডনি পাচার চক্র বিন্দোল অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠার সুযোগ
পেয়েছে৻
“বিন্দোল এলাকাটা উত্তর
দিনাজপুরের সবথেকে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর একটা৻ এখানে বছরে মাত্র মাস চারেক কাজ পায় মানুষ৻
অনেককে বাইরে কাজ করতে যেতে হয়৻ সেখানে গিয়েই অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে কিডনি
বিক্রি করেছেন৻ তবে আজকাল দেখা যাচ্ছে যে অনেকে টাকা রোজগারের সহজ পন্থা হিসাবে
নিজে থেকেই কিডনি বিক্রি করছে।”
আইন
বলছে অর্থের বিনিময়ে কিডনি দেওয়া নিষিদ্ধ৻ তা স্বত্বেও বিন্দোলের একের পর এক মানুষ
নিজেদের কিডনি বিক্রি করছেন আর গোটা চক্রের পেছনে মোনা গেছে দুজনের নাম - কুদ্দুস
আর আব্দুল রেজ্জাক৻
কুদ্দুস
নামের ওই ব্যক্তি সম্প্রতি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন – কিডনি
নিয়ে টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে৻
কুদ্দুসের
সহযোগী আব্দুল রেজ্জাক৻ তার হাত ধরেই বিন্দোলে কিডনি পাচার চক্রের শুরু ৻ তিনিই হলেন মূল
চক্রী - ইংরেজিতে যাকে বলে কিংপিন৻
এক
পাচারকারীর স্বীকারোক্তি
গ্রামে
অনেক গরীব মানুষ – তাদেরকেই বেশী নিয়ে যেতাম৻ গোঁড়ায় মুম্বাই নিয়ে
যেতাম অপারেশনের জন্য৻ কলকাতাতেও কয়েকটা অপারেশন করিয়েছি৻
আব্দুল
রেজ্জাক, সাবেক
কিডনি দালাল
জেল
খেটে এসে বাড়ীতেই থাকেন৻ এখন নাকি তিনি ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন৻ রোগা পাতলা চেহারার এই
প্রবীণ মানুষটাকে দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবেন না যে
সারা দেশের কিডনি পাচার চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন তিনি৻
সবিস্তারে
বিবিসিকে বলছিলেন কীভাবে শুরু করেছিলেন কিডনি পাচারের কাজ, “আমি
নিজে অনেকদিন আগে কিডনি বিক্রি করেছি৻ সেই থেকেই আমার যোগাযোগ শুরু হয়৻ গ্রামে অনেক গরীব মানুষ – তাদেরকেই
বেশী নিয়ে যেতাম৻
গোঁড়ায় মুম্বাই নিয়ে যেতাম অপারেশনের জন্য৻ কলকাতাতেও কয়েকটা অপারেশন করিয়েছি৻ পরে
অনেকে নিজেই আসত কিডনি বেচার জন্য৻ নথিপত্র ঠিক থাকলে তবেই আমি কাজ করাতাম৻ তবে
আমি কমিশন পেতাম খুবই কম৻”
রেজ্জাকের
কথায় কিডনি বিক্রেতা যোগাড় করার পরে ডাক্তার আর হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়৻ সেখানে রক্ত পরীক্ষা, টিস্যু
পরীক্ষার পরে ডাক্তাররা মিটিং করেন৻ নথিপত্র পরীক্ষা করা হয়৻ সবশেষে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে
ছাড়পত্র আনতে হয়৻
মি.
রেজ্জাক আর বিন্দোলের মানুষদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে কলকাতায় কোন কোন
হাসপাতালে এই বেআইনি কিডনির ব্যবসা চলে৻ তাঁরা যেসব হাসপাতালের নাম বলেছিলেন, সেগুলোর
মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটা হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনই রয়েছে মধ্য কলকাতার
এন্টালীর কাছে অবস্থিত রেমেডি নার্সিং হোমের নাম৻ আর এই বেসরকারি হাসপাতালটিতেই নাকি বে আইনি
কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন সবথেকে বেশী করা হয়৻
ওই
নার্সিং হোমের মালিক ডা. এম সি শীল বিবিসি-কে বলেন, “আমরা সরকারী ছাড়পত্র ছাড়া
কোনও কিডনি প্রতিস্থাপন করি নি৻ প্রত্যেক কিডনি দাতাকে আইন অনুযায়ী এফিডেফিট করতে হয় যে তিনি
টাকা না নিয়ে কিডনি দান করছেন – স্বেচ্ছায়৻ সেই এফিডেফিট পাওয়ার পরে সব
কাগজপত্র পাঠিয়ে দিই রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরে৻ তারা ছাড়পত্র দিলে তবে অপারেশন করি৻ সব
রেকর্ডই আমাদের হাসপাতালে রাখা আছে৻”
ডা.
শীল বলছিলেন যে নথিপত্র যাচাই করে তবেই তারা কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন করেন৻কিন্তু
কিডনি পাচার চক্রের অন্যতম মূল পাণ্ডা আব্দুর রেজ্জাক বলেন ঘুষ দিয়ে নথি জাল করা
যায়৻
হাসপাতালের
যোগসাজশ
সব
নথিপত্র নাকি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর বিচার বিবেচনা করার পরেই অনুমতি পাওয়া যায়
কিডনি প্রতিস্থাপনের৻
তাই অর্থের বিনিময়ে কথিত কিডনি দানের ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম স্বাস্থ্য
দপ্তরের মুখপাত্র ডা অসিত বিশ্বাসের সঙ্গে৻
ডা.
বিশ্বাস বলছিলেন, “যা পরিকাঠামো, তাতে
কোনও নথি জাল কী না সেটা যাচাই করা সম্ভব না৻ তবে ধরা পড়লে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে আইনে৻”
স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠনগুলো বলছে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনও লাভ হয় নি৻ তাই তারা বা স্থানীয়
পঞ্চায়েত এখন জোর দিচ্ছে সেইসব ব্যবস্থার ওপরে যাতে
স্থানীয় মানুষদের কাজের ব্যবস্থা করা যায় বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের মাধ্যমে – আর
সচেতনতা বাড়ানোর ওপর৻কিন্তু
তা সত্ত্বেও কিডনি পাচার থেমে নেই বিন্দোল বা আশপাশের এলাকায়। বিন্দোল থেকে তা
ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা সহ রাজ্যের অন্যান্য
এলাকাতেও৻
No comments:
Post a Comment