Wednesday, April 11, 2012

পশ্চিমা পরমাণু নীতির বিরুদ্ধে গুন্টার গ্রাসের সাহসী উচ্চারণ নন্দিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী


image_39356_0.jpg (400×390)নোবেল পুরুস্কার বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক ও লেখক গুন্টার গ্রাসের একটি কবিতা এখন বিশ্বব্যাপী চমক সৃষ্টি করেছে। "অবশ্যই যা বলা দরকার" শীর্ষক ওই কবিতাটি আলোচনা ও বিতর্কের ঝড় তুলেছে জার্মানিসহ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক মহলেও। জার্মানীর একটি দৈনিকে গত সপ্তায় ওই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর একদল ইসরাইলি ও ইসরাইলপন্থী জার্মান কর্মকর্তা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দখলদার ইসরাইল গুন্টার গ্রাসকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছে। গুন্টার গ্রাসের অপরাধ হল, তিনি সময়ের সাহসী উচ্চারণে এগিয়ে এসে ইরানে সম্ভাব্য ইসরাইলি হামলা ও ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে
কবিতা লিখেছেন। ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র "ভঙ্গুর হয়ে পড়া বিশ্ব শান্তিকে বিপদাপন্ন করছে" বলে গুন্টার গ্রাস ওই কবিতায় মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো লিখেছিলেন, "আমি আর নিরব থাকব না, কারণ, আমি পাশ্চাত্যের ভণ্ডামী বা দ্বৈত নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।" গ্রাস ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান পরমাণু অস্ত্র ও শক্তি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কয়েক যুগের নিরবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা কেন ইসরাইলের পরমাণু স্থাপনাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন না? কেন সেখানে পরিদর্শন সম্ভব হচ্ছে না? পশ্চিমা নেতাদের সবাই এ ব্যাপারে নিরব থেকে যে বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন তা দীর্ঘকাল ধরে মেনে চলা অসহনীয় মিথ্যার বোঝা বয়ে চলার মতই দু:সহ মনে হয়েছে গ্রাসের কাছে। তাই তিনি ওই কবিতায় বলেছেন, হ্যা, আমি জানি এই মিথ্যার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেই শাস্তি দিতে প্রতিজ্ঞ ওরা, তাদের বিচারের রায়ে আমি হয়ে পড়ব " ইহুদি-বিদ্বেষী" বা সেমিটিক-বিরোধী! 
বাস্তবেও ঘটছে তাই, যেমনটি ঘটেছে অতীতেও কথিত হলোকাস্ট বা ইহুদি-নিধন অস্বীকারের দায়ে। তথাকথিত বাক-স্বাধীনতার স্বর্গ হওয়ার দাবিদার পাশ্চাত্যের ইহুদিবাদ-ঘেঁষা রাজনীতিক ও সংবাদমাধ্যমগুলো ফুঁসে উঠেছে গ্রাসের বিরুদ্ধে। জার্মানির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটস বলেছে, তারা আর তাদের প্রচারণা-মিছিলে গ্রাসকে স্বাগত: জানাবে না। আর ইহুদিবাদীদের তো কথাই নেই। ইসরাইলের হিব্রু লেখক সমিতির ব্যানারে একদল ইসরাইলি লেখক নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাসের নোবেল কেড়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। তারা গুন্টার গ্রাসের "অবশ্যই যা বলা দরকার" শীর্ষক ওই কবিতার নিন্দা জানিয়েছে এবং বিশ্বের লেখকদেরকেও ওই কবিতার নিন্দায় শরিক হতে বলেছে। 
অবশ্য সুইডেনের সংশ্লিষ্ট একাডেমি গ্রাসের নোবেল কেড়ে নেয়ার দাবি নাকচ করে দিয়েছে। সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব পিটার এনগ্লান্ড গতকাল এ ব্যাপারে বলেছেন, "গুন্টার গ্রাস ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কেবল সাহিত্য-মানের কারণে এবং একমাত্র মানের ভিত্তিতেই- আর এ বিষয়টি সাহিত্যের অন্যান্য নোবেল বিজয়ীদের জন্যও প্রযোজ্য।'' তিনি বলেছেন, "ওই পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সুইডিশ একাডেমিতে কোনো আলোচনা হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও হবে না।'' জার্মান দৈনিক ডি ওয়াল্টের সম্পাদক হেনরিখ ব্রুকার বলেছেন, আমরা সবাই জানতাম যে ইহুদিদের সাথে গুন্টারের সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এবার তিনি খুব স্পষ্টভাবে তার ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ব্রুকার গ্রাসের কিছু কথা উদ্ধৃত করে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেমিটিক বিরোধী বলে ঘোষণা করেছেন। 
এদিকে বিশ্বব্যাপী মুক্ত-জনমতের জগতে পাশ্চাত্যের ইরান-বিদ্বেষ ও ইসরাইল-ঘেঁষা নীতির বিরুদ্ধে গুন্টারগ্রাসের অসংকোচ প্রকাশের এই দূরন্ত সাহস নন্দিত হচ্ছে। জার্মানির পিস মুভম্যান্ট বা শান্তি আন্দোলন গ্রাসের প্রতি ইসরাইল ও তার সমর্থকদের নিন্দাবাদের জবাবে নোবেল জয়ী এ লেখককে সমর্থন জানিয়েছে। এ দলের মুখপাত্র পিটার স্ট্রাটিনস্কি বলেছেন, "গ্রাসের ইসরাইল বিরোধী কথার নিন্দা জানানো উচিত নয়, বরং সেসব রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো উচিত যারা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, গ্রাস ইসরাইলের পরমাণু কর্মসূচী সম্পর্কে বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন। কারণ ইসরাইলের কাছে ২৫০টিরও বেশি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, অথচ তেলআবিব এখনও তার পরমাণু স্থাপনাগুলোয় আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না।" 
এটা স্পষ্ট গ্রাস হলোকাস্ট বা ইহুদি-নিধনের দাবির বিরুদ্ধে কথা বলেননি, তিনি মুসলমানদের প্রথম কেবলা অধ্যুষিত বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইসরাইলের ধ্বংসও দাবি করেননি এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ইরানের প্রতি সমর্থনও জানাননি, বরং তিনি বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়েই যুদ্ধ বিরোধী কথা বলেছেন এবং একটি সভ্যতা ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা রক্ষার দৃষ্টিকোন থেকে ইরানের পক্ষে কথা বলেছেন। গ্রাসের কবিতার সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধ-অপরাধেরও কোনো সম্পর্ক নেই। ইহুদিবাদী দখলদার শক্তি ও তাদের সমর্থকরা ফিলিস্তিনে জবর-দখল প্রতিষ্ঠা ও সেখানে একটি বর্ণবাদী সরকার বসানোর ব্যাপারে মোটেই লজ্জিত নয়। অথচ শান্তিকামী ও মানব-প্রেমে উদ্বুদ্ধ কোনো ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তি যখনই ইসরাইলের সমালোচনা করেন তখনই তাকে ইহুদি-বিদ্বেষী বলে ঘায়েল করা হয়। 
গুন্টার গ্রাস জার্মানির জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও কবি। তাই তার গায়ে ইহুদি-বিদ্বেষী লেবেল লাগানো হলেও তা ধোপে টিকবে না। গত কয়েক দিনে তার প্রতি জার্মানির বিবেকবান জনগণের সমর্থন যেভাবে উপচে পড়েছে তা ইহুদিবাদীদের অসহায়ত্ব তুলে ধরার মেকি প্রচেষ্টার মোকাবেলায় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই ৮৪ বছর বয়স্ক গ্রাস হয়ে পড়েছেন জার্মানির জাগ্রত গণ-বিবেকের প্রতীক। এ বয়সে গ্রাসের হারানোর কিছুই নেই। এই ঐতিহাসিক কবিতা লিখে গ্রাস এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, ইসরাইলের মিথ্যাচার ও বিশ্ব-শান্তি বা বিশ্বের নিরাপত্তার প্রতি ইসরাইলের বিপজ্জনক অস্তিত্বের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ না করে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছুক নন। 

No comments:

Post a Comment